ফতুল্লা প্রতিনিধি
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ড্রামের ভেতর থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মো. নয়ন (৪৯) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে নিহতের স্ত্রী, মেয়েসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হত্যার পেছনে রয়েছে পরকীয়া প্রেম ও পারিবারিক কলহ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—নিহতের দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা (৪০), তার দুই মেয়ে সুমনা (২০) ও সানজিদা (১৮), সাবিনার পরকীয়া প্রেমিক রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেল (৪৫), সহযোগী চয়ন (৪০) ও মানিক মিয়া (৩৫)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে ফতুল্লার তক্কার মাঠ–নন্দলালপুর সড়কের দক্ষিণ পাশে মাওয়া মার্কেটের পেছনের ঝোপ থেকে নীল রঙের একটি ড্রামের ভেতর পচা গন্ধ পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ড্রামের মুখ খুলে পলিথিনে মোড়ানো নয়নের লাশ উদ্ধার করে।
লাশটির হাঁটুর নিচ থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। উদ্ধার করা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। পরে রাত ৯টার দিকে ফতুল্লার পিলকুনি প্রাইমারি স্কুলের বিপরীতে হিটলারের বাড়ির সামনে থেকে নয়নের বিচ্ছিন্ন দুই পা উদ্ধার করে পুলিশ এবং মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত নয়ন ফতুল্লার নন্দলালপুর এলাকার মো. সালামের ছেলে। তিনি পেশায় মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও ছিনতাইসহ অন্তত ৮–১০টি মামলা রয়েছে। প্রায় তিন বছর আগে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হন তিনি। আড়াই বছর কারাভোগের পর ৮–১০ দিন আগে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
নয়নের প্রথম স্ত্রী সাহিদা পিলকুনি এলাকায় থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা ব্যাংক কলোনী এলাকায় বাস করতেন। ৪–৫ বছর আগে সাবিনাকে বিয়ে করার পর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে নয়নের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
নয়নের কারাবাসের সময় সাবিনার সঙ্গে এলাকার অপর এক মাদক কারবারি রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেলের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জামিনে মুক্ত হয়ে নয়ন দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায় উঠলে ওই পরকীয়ার ঘটনা তার নজরে আসে। এরপর থেকেই স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে তীব্র কলহ শুরু হয়।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নয়ন পরকীয়ার বিষয়টি জানার পর সাবিনা, তার দুই মেয়ে, রাসেল ও সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে নয়নকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা চালানো হয়। লাশ ড্রামে ভরতে সমস্যা হওয়ায় হাঁটুর নিচ থেকে পা দুটি কেটে ফেলা হয়। এরপর পলিথিনে মোড়িয়ে ড্রামের মধ্যে ভরে মাওয়া মার্কেট এলাকার পেছনের ঝোপে ফেলে দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি দশ পাইপ এলাকা থেকে সাবিনা, তার দুই মেয়ে সুমনা ও সানজিদা এবং সহযোগী চয়নকে আটক করা হয়। একই রাতে মানিক মিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
ফতুল্লা মডেল থানার এসআই রেহানুল ইসলাম বলেন, ঝোপের মধ্যে ফেলে রাখা ড্রাম থেকে দুর্গন্ধ বের হলে স্থানীয়রা খবর দেয়। আমরা গিয়ে পলিথিনে মোড়ানো লাশ উদ্ধার করি। পরে অভিযান চালিয়ে বিচ্ছিন্ন পা উদ্ধার ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়।”
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী বলেন,
“নিহত নয়ন একজন মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। জামিনে মুক্তির ৮–১০ দিনের মাথায় তিনি হত্যার শিকার হন। পারিবারিক কলহ ও পরকীয়া প্রেমের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে।”
নয়ন এলাকায় একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি ছিলেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনার বিরুদ্ধেও পতিতাবৃত্তি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ ছিল। দীর্ঘদিনের অপরাধচক্র, পারিবারিক অশান্তি ও অবৈধ সম্পর্কের জটিলতা শেষ পর্যন্ত নয়নের প্রাণ কেড়ে নেয়।