ফতুল্লায় আলোচিত নয়ন হত্যা মামলার ৭ আসামি গ্রেপ্তার

ফতুল্লা প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পরকীয়ার জেরে মো. নয়ন (৪৮) নামে এক অটোরিকশাচালককে নির্মমভাবে হত্যা করে মরদেহ টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখার ঘটনাটি জেলাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নিহতের স্ত্রীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আদালত ইতোমধ্যে আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

পুলিশ জানায়, গত ৫ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম দেলপাড়া মির্জা বাড়ি এলাকার আকিল উদ্দিনের পাঁচতলা ভবনের চতুর্থ তলায় পরিকল্পিতভাবে নয়নকে হত্যা করা হয়। পরের দিন (৬ অক্টোবর) সকালে ফতুল্লার উত্তর শিয়াচর এলাকার তক্কারমাঠের কাছে একটি ফাঁকা জমিতে রাখা নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে নয়নের দুই পা ছাড়া দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

একইদিন নয়নের বিচ্ছিন্ন দুটি পা ও হত্যার আলামত—একটি তোশকের ভেতরে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায়—উদ্ধার করা হয় পিলকুনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের একটি গলি থেকে।

নিহত নয়ন শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার কানারগাঁও গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে। তিনি ফতুল্লার পাগলা নন্দলালপুর মসজিদ গলিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং জীবিকা নির্বাহ করতেন অটোরিকশা চালিয়ে।

এ ঘটনায় নিহতের বাবা আব্দুস সালাম (৭৭) বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পরপরই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের নির্দেশে ফতুল্লা থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সমন্বয়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন ফতুল্লা থানার তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। তত্ত্বাবধান করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) তারেক আল মেহেদী ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার “ক” সার্কেল মো. হাসিনুজ্জামান। এ অভিযানে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—সাবিনা ওরফে সাবরিনা (৩৮) – নিহতের দ্বিতীয় স্ত্রী, রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেল – সাবিনার পরকীয়া প্রেমিক, চয়ন (৩৮), জুয়েল (২৮), নোমান ওরফে মানিক (২৮), সুমাইয়া (২০) ও সানজিদা ওরফে সাজু (১৮)

প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নয়নের দুটি সংসার ছিল। প্রথম স্ত্রীর নাম সাহিদা বেগম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম সাবিনা। সাবিনার আগের সংসারে সুমাইয়া ও সানজিদা নামে দুই মেয়ে রয়েছে।

প্রায় তিন বছর আগে মাদক মামলায় কারাগারে গেলে নয়নের স্ত্রী সাবিনা প্রতিবেশী রাসেল ওরফে ঠোঙ্গা রাসেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। জামিনে মুক্তি পেয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর বাসায় ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে সন্দেহে দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে। প্রতিদিনই চলতে থাকে ঝগড়া-বিবাদ ও পারিবারিক কলহ।

৫ অক্টোবর দুপুরে রাসেল সাবিনার ফ্ল্যাটে গেলে নয়নের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সাবিনা ও রাসেল মিলে নয়নকে ঘরের এক কক্ষে আটকে ফেলে। এরপর লোহার রড ও ধারালো ছোরা দিয়ে তাকে নির্মমভাবে আঘাত করে হত্যা করে।

হত্যার পরের দিন (৬ অক্টোবর) সকালে সাবিনা, রাসেল, চয়ন, জুয়েল, নোমান, সুমাইয়া ও সানজিদা—এবং পলাতক সামিরসহ আরও কয়েকজন মিলে নয়নের মরদেহের দুই পা হেক্সব্লেড দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে। এরপর মরদেহের অংশগুলো আলাদা স্থানে ফেলে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত সুমাইয়া ও সানজিদার ২ দিনের এবং বাকিদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পরকীয়ার টানাপোড়েন ও পারিবারিক কলহ থেকেই এ ঘটনার সূত্রপাত। তবে হত্যার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা কারও প্ররোচনা আছে কিনা সেটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও কয়েকজন সহযোগী এখনো পলাতক রয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি হত্যার পেছনে মাদক ব্যবসা বা স্থানীয় অপরাধী চক্রের কোনো যোগসাজশ আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এই হত্যাকাণ্ড কেবল পারিবারিক কলহ নয়, বরং একটি ভয়াবহ পরিকল্পিত অপরাধের দৃষ্টান্ত। গৃহের ভেতর থেকেই কীভাবে একজন সাধারণ অটোরিকশাচালক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্মমভাবে খুন হতে পারেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই ঘটনা। এতে স্পষ্ট যে, পারিবারিক বিবাদ ও অবৈধ সম্পর্ক কখনও কখনও কতটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *