স্পেশাল রিপোর্ট
গত ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে আওয়ামী লীগপন্থী জনপ্রতিনিধিদের গা ঢাকা দেয়ার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জেও। একসময় রাজনৈতিকভাবে তৎপর ও প্রশাসনিকভাবে সচল এই নগর এখন কার্যত জনপ্রতিনিধিশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে নগরবাসীর নিত্যদিনের নাগরিক জীবন দুর্ভোগে নিমজ্জিত।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক)-এর ২৭টি ওয়ার্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ২৭ জন নির্বাচিত কাউন্সিলর ও একজন মেয়র। কিন্তু বর্তমানে গোটা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে একজন প্রশাসককে। মেয়র ও কাউন্সিলররা কেউই নেই তারা হঠাৎ করেই ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আত্মগোপনে চলে যান।
সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড সচিবরা দায়িত্বে থাকলেও, স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে তারা কার্যত কোনো উন্নয়নমূলক বা নাগরিক সেবামূলক কার্যক্রমে উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তাদের কাজ এখন সীমিত হয়ে পড়েছে কাগজপত্র প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতায়।
নারায়ণগঞ্জ নগরীর সবচেয়ে বড় নাগরিক সমস্যা এখন পরিচ্ছন্নতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থায় স্থবিরতা। আগে নির্বাচিত কাউন্সিলররা নিয়মিত তদারকি করতেন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ ও ড্রেন পরিষ্কার কার্যক্রম। এখন সেই কাজ অনেকটাই বন্ধ বা ধীরগতির।
খানপুর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের এলাকার ড্রেন বন্ধ হয়ে রাস্তায় পানি জমে আছে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে। আগে কাউন্সিলরকে জানালে একদিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যেত। এখন বলার মতো কেউ নেই।
অনুরূপ অভিযোগ এসেছে নন্দীপাড়ার বাসিন্দা পারভীন আক্তারের কাছ থেকেও। তিনি বলেন, বাড়ির পাশে আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। কেউ পরিষ্কার করছে না। ফোন দিলেও সচিবরা বলে ‘উপর থেকে নির্দেশ আসলে হবে’। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
শুধু পরিচ্ছন্নতা নয়, সড়ক ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছোটখাটো গর্ত, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট বা ফুটপাত মেরামতের কাজ সাধারণত জনপ্রতিনিধিরা নিজস্ব অর্থায়ন ও তদারকিতে করতেন। কিন্তু বর্তমানে কোনো কাউন্সিলর না থাকায় এইসব ছোট ছোট কাজেরও কোনো সমাধান হচ্ছে না।
ওয়ার্ড সচিবরা প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাজেট ব্যবহারের ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে মেরামত কাজের জন্য কোনো নির্দেশনা বা অর্থ বরাদ্দও হচ্ছে না।
বর্তমানে পুরো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন একজন প্রশাসক। তিনি নিয়মিতভাবে অফিসিয়াল কাজ যেমন ফাইল পাস করা, দাপ্তরিক অনুমোদন ও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কাজ যেমন ময়লা অপসারণের গতি বাড়ানো, ড্রেন পরিষ্কার, সড়ক মেরামত, নাগরিক সমস্যায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এইসব কার্যক্রম একা একজন প্রশাসকের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তার ভাষায়, ২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিদিনের সমস্যার সমাধান একজন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। এখানে জনপ্রতিনিধিরা থাকলে তারা মাঠপর্যায়ে দ্রুত সমাধান দিতেন।
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগপন্থী জনপ্রতিনিধিদের হঠাৎ আত্মগোপনে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি কাজ করেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দলীয় দিক থেকে কোনো নির্দেশ না থাকায় মেয়র ও কাউন্সিলররা সময় পরিস্থিতি না বোঝা পর্যন্ত প্রকাশ্যে না আসার কৌশল নিয়েছেন।
এতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি প্রশাসনিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে নাগরিক সেবা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকলে ওয়ার্ড পর্যায়ে বাজেট বাস্তবায়ন ও কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণও সম্ভব হয় না।
নগরবাসীরা বলছেন, জনপ্রতিনিধিরা থাকলে ছোটখাটো সমস্যা থেকে শুরু করে বড় কোনো অবকাঠামোগত সমস্যাও দ্রুত সমাধান হতো। এখন তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, কাউকে ধরাও যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনের নাগরিক সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছে।
চাষাঢ়ার ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, আগে রাতে রাস্তার লাইট না জ্বললে কাউন্সিলরকে ফোন করলেই পরদিন ঠিক হয়ে যেত। এখন ফোন করার কেউ নেই, লাইট বন্ধ থাকছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।
গোয়াল পাড়ার গৃহবধূ রাবেয়া খাতুন বলেন,আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিনগুলো উপচে পড়ছে, ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না সমাধানের জন্য।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কোনো সিটি কর্পোরেশন দীর্ঘ সময় সচল রাখা সম্ভব নয়। একজন প্রশাসক শুধু ফাইল ঘোরানো ও নিয়মিত কাজ করতে পারেন, কিন্তু জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে সেবা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
নাগরিকরা এখন প্রশ্ন তুলছেন এই অবস্থা কতদিন চলবে? রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে প্রশাসনিক এই স্থবিরতা শহর ব্যবস্থাপনায় আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে। সেবা ব্যাহত হওয়া ছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি কমে যেতে পারে, বাজেট খরচে জটিলতা দেখা দিতে পারে, এবং নাগরিক অসন্তোষ বাড়তে পারে।
অনেকে বলছেন, পরিস্থিতি যদি দ্রুত স্বাভাবিক না হয় তবে প্রশাসক ও সচিবদের মধ্যে বিকল্প একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা উচিত।
রাজনৈতিক কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি এখন পুরো নগরজীবনের জন্য এক বড় ধরনের সংকটে রূপ নিয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ সব জায়গায় স্থবিরতা। একজন প্রশাসকের পক্ষে এত বড় দায়িত্ব একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। দ্রুত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমাধান না হলে এই দুর্ভোগ আরও গভীর আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা।