ট্রিবিউন ডেস্ক রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি সবসময়ই উত্তপ্ত। বিশেষত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা, যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দলবদল আর ক্ষমতার দখলদারিত্ব দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রে। সাম্প্রতিক সময়ে এখানকার ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা পরিচয়ে পরিচিত দেলু ভুঁইয়া এবং তার পরিবারকে ঘিরে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা অভিযোগ করছেন—দেলু ভুঁইয়া আসলে বিএনপির সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। বরং দলের নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করেছেন। বিগত সরকার আমলে তার ছেলে ইরফান ভূঁইয়াসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলো। একই সঙ্গে দেলু ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে ড্রেজার সন্ত্রাস, নদী দখল ও অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি শ্রমিক দলের নাম ব্যবহার করে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় একদল প্রভাবশালী ব্যক্তি চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন শ্রমিক দলের নেতা কাজী অকিল আহাম্মেদ। এসব ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা যেমন বিব্রত, তেমনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
দেলু ভুঁইয়া দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে বিএনপি নেতা পরিচয়ে পরিচিত হলেও বাস্তবে তাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মসূচি বা আন্দোলনে দেখা যায়নি। বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ে তিনি সবসময় আড়ালে থেকেছেন।
স্থানীয়রা বলেন, তিনি মাঠের রাজনীতির মানুষ নন। দলের সুবিধা নেওয়া, নেতা পরিচয়ে প্রভাব খাটানোই তার কাজ।”
রাজনৈতিক সূত্র মতে, দেলু ভুঁইয়া ৯০–এর দশকে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেন। তবে পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেকে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশি মনোযোগী হন। রাজনীতিকে তিনি ব্যবহার করেছেন পরিচয় ও সুরক্ষার জন্য, কিন্তু মাঠের কর্মীদের পাশে থাকার ইতিহাস নেই।
দেলু ভুঁইয়ার ছেলে ইরফান ভুঁইয়া প্রথমদিকে বিএনপির ব্যানারে সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি দেখা যেত। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং ও সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, সোনারগাঁ থানায় হেফাজতের দেওয়া একটি হত্যা মামলায় ৪৭ নাম্বার আসামি দেলু ভূঁইয়ার ছেলে ইরফান ভুইয়া।
এতে তৃণমূলের বিএনপি কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন যে পরিবার বিএনপির নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেয়, অথচ বাস্তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের কারণে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি কেবল দলবদলের ঘটনা নয়; বরং প্রমাণ করে, দেলু ভুঁইয়া পরিবার কখনোই বিএনপির প্রতি আন্তরিক ছিল না। তারা সুবিধাবাদী রাজনীতির অংশ, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় একটি সমস্যা।
দেলু ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নদী দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন এবং তার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা তার বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, দেলু ভুঁইয়া রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন করতেন। এতে শুধু পরিবেশ নষ্ট হয়নি, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষও ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।”
এলাকাবাসীর কাছে দেলু ভুঁইয়া রাজনৈতিক নেতার চেয়ে ড্রেজার সন্ত্রাসী হিসেবেই বেশি পরিচিত। এই পরিচিতিই এখন বিএনপির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অন্যদিকে সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপি শ্রমিক দলের নাম ব্যবহার করে একদল প্রভাবশালী অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শ্রমিক দলের নেতা কাজী অকিল আহাম্মেদ আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
তার দাবি, আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় কাউন্সিলর মতিউর রহমান ওরফে ‘মতি’র ছত্রছায়ায় এরা অপরাধ চালাত। সরকারের পতনের পরও আত্মগোপনে থেকে এখন শ্রমিক দলের নাম ব্যবহার করে অবৈধ অফিস চালাচ্ছে। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
২০২৫ সালের ২১ জুন কাজী অকিল বৈধ কাগজ চাইতে গেলে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জানানো হয়েছে।
তৃণমূল নেতাদের বক্তব্যে ক্ষোভ স্পষ্ট। এক নেতা বলেন, আমরা রাজপথে আন্দোলন করি, পুলিশি হয়রানি সহ্য করি। অথচ কিছু সুবিধাবাদী নেতা পরিবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, আবার শ্রমিক দলের নাম ভাঙিয়ে অপরাধীরা অফিস খোলে। এতে সাধারণ মানুষ বিএনপিকে সন্দেহের চোখে দেখে।”
আরেকজন বলেন, যারা মাঠে নেই, তারাই দলের নাম ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছে। এতে আসল কর্মীরা হতাশ হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সবচেয়ে বড় সংকট হলো সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বহীনতা। দেলু ভুঁইয়ার মতো নেতাদের দ্বৈত অবস্থান সেই দুর্বলতাকে আরও প্রকট করছে।সাধারণ মানুষ বিএনপিকে অপরাধী বা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা হিসেবে দেখতে শুরু করলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।প্রকৃত কর্মীরা যখন অবহেলিত হবে আর সুবিধাবাদীরা প্রভাব বিস্তার করবে, তখন দলীয় সংহতি নষ্ট হবে।আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দূর করতে না পারে, তবে সিদ্ধিরগঞ্জের মতো এলাকাগুলোতে তারা মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়বে।
সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির রাজনীতি বর্তমানে দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে দেলু ভুঁইয়া পরিবারের দ্বৈত ভূমিকা ও দলবদল, অন্যদিকে শ্রমিক দলের নামে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য—সব মিলিয়ে দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির জন্য এটি একটি বড় সতর্কবার্তা। যদি তারা সময়মতো এ ধরনের সুবিধাবাদী নেতাদের ছেঁটে ফেলতে না পারে, তবে কর্মী-সমর্থকদের আস্থা হারাবে এবং নির্বাচনী মাঠে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হবে।