ট্রিবিউন ডেস্ক রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতি নতুন মোড় নিতে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা ত্যাগী নেতারা এখন প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন। তাঁদের জায়গা দখল করছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি শ্রেণি, যাঁরা শক্তিশালী আর্থিক অবস্থানকে পুঁজি করে দলে প্রবেশ করছেন। ফলে মহানগর বিএনপির ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্ব কাঠামোতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মহানগর আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান এবং সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপুর রাজনৈতিক অবস্থান আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন খান ও এড. টিপু দুজনই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির পরিচিত নাম। দলে যখন আন্দোলন, মিছিল বা গ্রেপ্তার-হামলার পরিস্থিতি তৈরি হতো তখন এঁরাই ছিলেন রাজপথের ভরসা। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। তাঁদের চারপাশের নেতাকর্মীরা একে একে শিল্পপতি নেতাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। ফলে তাঁরা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক শক্তি ও জনপ্রশাসনে লবিং করার সামর্থ্য যাঁদের বেশি, তাঁরাই এখন বিএনপির রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন মাসুদুজ্জামান মাসুদ। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসার পাশা-পাশি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বিএনপির রাজনীতিতে সরাসরি মাঠে না থাকলেও তাঁর আর্থিক অবস্থান শক্তিশালী। যোগদানের দিন থেকেই তিনি নিজের অবস্থান জানান দেন, যা দলের ভেতরে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ঘোষণা আসে। প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহামেদ বাবুল নিজ বাড়িতে স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে ঘোষণা দেন যে, তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
বাবুলের এ ঘোষণায় নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় রাজনীতির মাঠে হঠাৎ করে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। যাঁরা এতদিন সাখাওয়াত-টিপুদের পাশে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই শিল্পপতিদের শক্তি ও সম্ভাবনা দেখে অবস্থান পরিবর্তন করছেন।
রাজনীতিতে টিকে থাকতে জনসম্পৃক্ততা অপরিহার্য। ত্যাগী নেতারা রাজপথে লড়াই করে কর্মীদের আস্থা অর্জন করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকার কারণে অর্থনৈতিক সংকট, মামলা-হামলার চাপ ও সীমিত সাংগঠনিক সুবিধার কারণে তাঁদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে নতুন আসা শিল্পপতিরা আর্থিক সহায়তা, কর্মসূচি আয়োজন, কর্মীদের প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন।
অনেকে মনে করছেন, কর্মীরা এখন বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। নেতৃত্ব যাঁর হাতেই হোক, নির্বাচনী সম্ভাবনা বেশি যাঁর, তাঁর দিকেই ঝুঁকছেন সকলে। ফলে ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বাড়ছে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কামাল বিএনপির এক পরিচিত মুখ। অতীতে তিনি এ আসন থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখনও তিনি মাঠে সক্রিয় আছেন। তবে শিল্পপতিদের সরব প্রচারণা ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেছেন তিনি।
কামালের পক্ষে রয়েছে রাজপথে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ও সাধারণ নেতাকর্মীদের আবেগ। কিন্তু শিল্পপতিদের পক্ষে রয়েছে অর্থ, সংগঠন চালানোর ক্ষমতা ও গণমাধ্যমে প্রচারের সুবিধা। এই প্রতিযোগিতায় কে টিকে থাকবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির অনেক তৃণমূল কর্মী মনে করছেন, দলে ত্যাগী নেতৃত্বের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যাঁরা মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন, যাঁরা বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, তাঁদের অবদান মূল্যায়িত হচ্ছে না। অন্যদিকে হঠাৎ করে আসা শিল্পপতিরা কেন্দ্র ও স্থানীয় পর্যায়ে গুরুত্ব পাচ্ছেন। এতে দীর্ঘদিনের কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ বাড়ছে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন সবসময়ই আলোচিত। আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির লড়াই এখানে তীব্র হয়ে থাকে। তবে এবার বিএনপির ভেতরেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি শিল্পপতি নেতৃত্ব ও পুরনো নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয় না হয়, তবে অন্যান্য দলের প্রার্থী নিরঙ্কুশ সুবিধা পেতে পারেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্র যদি সঠিক সময়ে প্রার্থী নির্ধারণ না করে এবং অভ্যন্তরীণ সংকট মেটাতে না পারে, তবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা কমে আসবে।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতিতে এখন যে পরিবর্তন ঘটছে তা কেবল একটি জেলার চিত্র নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ের একটি ট্রেন্ডের প্রতিফলন। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শিল্পপতি শ্রেণি এখন রাজনীতিতে প্রবেশ করছে এবং ত্যাগী নেতাদের জায়গা দখল করছে। এতে দলীয় রাজনীতির চরিত্র বদলাচ্ছে।
সাখাওয়াত হোসেন খান ও এড. টিপুদের মতো ত্যাগী নেতাদের অবদান ভুলে গেলে বিএনপির রাজনীতি আদর্শ হারাবে। আবার শিল্পপতিদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলে দলের সাংগঠনিক শক্তি ও নির্বাচনী সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সামনে আসছে এক কঠিন সমীকরণ ত্যাগী নেতৃত্ব ও শিল্পপতি নেতৃত্বের সমন্বয়।