ভিক্টোরিয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের উপচে পড়া ভীর

স্পেশাল রিপোর্ট

নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। জেলার প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ। চিকিৎসার জন্য আসা রোগীর সংখ্যা বেডসংখ্যার বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে অসংখ্য রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসক ও নার্সদের ওপরও পড়ছে বাড়তি চাপ, আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এখনই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

রবিবার ( ১৯ অক্টোবর) সকালে সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ড এবং ডেঙ্গু নির্দিষ্ট ইউনিটে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে রোগীদের। অনেকেই মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে আছেন, পাশে স্যালাইন ঝুলছে। কিছু রোগীকে করিডোর ও বারান্দায় রাখা হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫০০ জন ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালে গড়ে ২,০০০ জনের বেশি মানুষ ডেঙ্গু টেস্ট করাচ্ছেন। এই বিপুল চাপ মোকাবিলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে।

হাসপাতালের এক সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত বেড নেই। ওয়ার্ডে যা আছে তার তিনগুণ রোগী ভর্তি। অনেক রোগীকে করিডোরে রাখতে হচ্ছে। চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটছে, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই এটাই বাস্তবতা।

একজন রোগীর স্বজন সুলতানা আক্তার জানান, আমার ছেলে গতকাল ভর্তি হয়েছে। জায়গা না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। স্যালাইনের বোতলটাও নিজের খরচে কিনেছি। ডাক্তাররা খুব ব্যস্ত, একজনকে ডাকলে আরেকজনকে দেখতে সময় পাচ্ছেন না।

জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মুশিউর রহমান বলেন, শহরের ভেতরে ও আশপাশের এলাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা, এবং নাগরিক অসচেতনতার কারণে মশার প্রজনন বেড়েছে। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ এখন মহামারির পর্যায়ে। গত দুই সপ্তাহে জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সদর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

একজন সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন,এটা সত্যি, আমাদের নিয়মিত ফগিং ও লার্ভা ধ্বংস অভিযানে ঘাটতি আছে। কয়েকটি ওয়ার্ডে ফগিং যন্ত্র নষ্ট থাকায় নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা এখন জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছি।

শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না হওয়ায় পানি জমে আছে। আবর্জনায় ভরা নালায় ও স্থির পানিতে মশার লার্ভার জন্ম হচ্ছে।

তাছাড়া, অনেক বাড়ির ছাদ ও বারান্দায় জমে থাকা পানিতেও পাওয়া যাচ্ছে মশার প্রজননস্থল। বাসাবাড়িতে পুরোনো ফুলের টব, পানির ট্যাংক ও ড্রামের ঢাকনা খোলা পড়ে থাকায় এগুলোও মশার আদর্শ বাসস্থান হয়ে উঠেছে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সরকারি হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭০–৮০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর তথ্য সরকারি হিসাবে না আসায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন,অনেক রোগী প্রাথমিকভাবে বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে থাকছেন। কিন্তু তাদের তথ্য আমাদের কাছে আসছে না। ফলে আক্রান্তের প্রকৃত পরিসংখ্যান অনেক সময় ধরা পড়ে না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিকদের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধন কার্যক্রম চালানোর। কিন্তু নাগরিকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম অনেকটাই কাগুজে পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনলে নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু অঘোষিত জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে পারে। দ্রুত বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার, লার্ভা ধ্বংস অভিযান, এবং হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি বলে তারা মত দিচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন শুধুই স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বে সীমাবদ্ধ নয়—এটি পরিণত হয়েছে একটি সমন্বিত নগর সংকটে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জনসচেতনতার ঘাটতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনই কঠোর ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *