স্পেশাল রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জ এক সময় শিল্পনগরী, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ জেলার চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। খুন, হত্যাচেষ্টা, আত্মহত্যা এবং সহিংস ঘটনার খবরে প্রতিদিনই সংবাদ শিরোনামে আসছে নারায়ণগঞ্জ। গত ১৫ দিনে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের সদর, বন্দর, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ এবং সোনারগাঁও উপজেলায় একাধিক খুন সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে, পারিবারিক কলহ থেকে স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন, প্রেমঘটিত দ্বন্দ্বে কিশোরের লাশ উদ্ধার, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগ-বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত, মাদক ব্যবসায়ীর হাতে প্রতিপক্ষ খুন।এমন নৃশংস ঘটনাগুলো স্থান পেয়েছে স্থানীয় সংবাদপত্রসহ জাতীয় গনমাধ্যম গুলোতেও।
এছাড়া আত্মহত্যার ঘটনাও কম নয়। হতাশা, দাম্পত্য কলহ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবহেলার কারণে কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও ফতুল্লায় সম্প্রতি একদিনেই তিনজনের আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ঘটনার পরপরই অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা প্রতিটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। কিছু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত দ্রুত এগিয়ে চলছে।
তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, বারবার এমন হত্যাকাণ্ড ঘটায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। পুলিশের ধারণা, বেশিরভাগ খুন মাদক ব্যবসা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে।
এক সময় নারায়ণগঞ্জ শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যের জন্য পরিচিত ছিল। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই শহর এখন ভয় ও শঙ্কার নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের অস্থিরতায় সাধারণ মানুষ চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছে।
শহরের বাসিন্দা জাহিদ হোসেন বলেন, আগে নারায়ণগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানার খবরে সংবাদমাধ্যম ভরতো। এখন প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন বা আত্মহত্যার খবর পাই। সন্তানদের নিরাপদে স্কুলে পাঠাতে ভয় হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নারায়ণগঞ্জে খুন ও আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ায় তুচ্ছ ঘটনাতেই মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।বেকারত্ব ও দারিদ্র্য: কাজের অভাব, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং হতাশা অনেককে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।মাদকাসক্তি ও অপরাধ চক্র: ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ লেগেই থাকে।আইন প্রয়োগে শিথিলতা, অপরাধীরা দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবও অনেক সময় অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আল মেহেদী জানায়, আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছি যেখানেই যখন যেকোন ঘটনা ঘটছে আমরা সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে গিয়ে সেখানে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করছি। আশা করছি খুব দ্রুত নারায়ণগঞ্জকে অপরাধ প্রবন এলাকা থেকে বের করে নিয়ে আসবো।
নারায়ণগঞ্জ এক সময় শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক খুন, আত্মহত্যা ও অপরাধের খবরে শহরবাসী আতঙ্কিত। সাধারণ মানুষ আশা করছে, প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, মাদকবিরোধী কার্যক্রম ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা ছাড়া এ প্রবণতা থামানো সম্ভব নয়।