সিদ্ধিরগঞ্জে একের পর এক বিস্ফোরণে আতঙ্ক: রহস্যের জট খুলছে না 

স্পেশাল রিপোর্ট

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা যেন এখন আতঙ্কের আরেক নাম। প্রায় সময় পরপর একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এতে আহত হচ্ছেন অনেকে, এমনকি প্রাণহানিও ঘটেছে। কিন্তু রহস্যজনক বিষয় হলো, এসব ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনো সঠিকভাবে উদ্ঘাটন করতে পারেনি প্রশাসন। ফলে দিন দিন ভয় ও উৎকণ্ঠায় জীবনযাপন করছেন এলাকার বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা বলছেন, তারা আর নিরাপদ নন। বাসা-বাড়ি, দোকানপাট কিংবা রাস্তায়—যেকোনো জায়গায় হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। অনেক সময় আগুন ধরে যায়, আবার কোনো কোনো ঘটনায় ঘরবাড়ি ও দোকানের দেয়াল ভেঙে পড়ে। এতে নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।

একজন দোকানি বলেন, আমরা ব্যবসা করছি আতঙ্ক নিয়ে। কখন কোথা থেকে বিস্ফোরণের শব্দ আসবে, তা বলা মুশকিল। গ্রাহকরাও ভয়ে এখানে আসতে চায় না।অন্যদিকে একজন গৃহিণীর ভাষ্য, আমরা ঘরে বসেও নিরাপদ নই। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় লাগে। প্রতিদিন মনে হয়—আজ হয়তো আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে।

প্রতিবার বিস্ফোরণের ঘটনার পর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তদন্ত শুরু হয়, প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয় কখনো গ্যাস লাইনের লিকেজ, কখনো বিদ্যুতের শর্টসার্কিট, আবার কখনো সম্ভাব্য নাশকতার কথা শোনা যায়। কিন্তু সময় গড়ালেও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উদ্ঘাটন করা যায় না।

একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন সবসময়ই ঘটনার পর তৎপর হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোনো পদক্ষেপ নেয় না। ফলে কিছুদিন শান্ত থাকার পর আবারও বিস্ফোরণ ঘটে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে গ্যাস লাইন ফাঁসের বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে সন্দেহজনক উপাদান পাওয়া গেছে। সেগুলো গভীরভাবে যাচাই করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বিশেষজ্ঞরা একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করছেন,গ্যাস লাইন ফাঁস  নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পুরনো ও জীর্ণ গ্যাস পাইপলাইনের সংখ্যা অনেক। অনেক জায়গায় অননুমোদিত সংযোগও রয়েছে। এসব জায়গায় লিকেজ হলে সামান্য স্পার্কেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।বিদ্যুতের শর্টসার্কিট – অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিম্নমানের তার ব্যবহার বিদ্যুতের শর্টসার্কিট ঘটিয়ে বিস্ফোরণের সূত্রপাত করতে পারে।রাসায়নিক মজুত – সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় অনেক গুদাম, কারখানা ও ছোট ছোট কেমিক্যাল স্টোরেজ রয়েছে। এসব জায়গায় অগ্নিনিরাপত্তার কোনো মানদণ্ড না থাকায় সামান্য অসতর্কতাতেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।নাশকতার আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ মনে করে, সব বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা নয়। কোনো কোনো ঘটনায় নাশকতার উপাদান থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।

গত কয়েক বছরে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কিছু উদাহরণ  হিসেবে যদি বলি, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বাসায় গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৩ জন নিহত হন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিদ্ধিরগঞ্জের একটি দোকানে হঠাৎ বিস্ফোরণে আহত হন অন্তত ৭ জন। ২০২৪ সালের জুনে একটি গুদামে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত ২২ আগস্ট ২০২৫সালের রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসার বিস্ফোরণের ঘটনায় আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন পাইনাদী সিআইখোলা বউবাজার এলাকায় ২৬ আগস্ট মঙ্গলবার ২০২৫ সালে ড্রেনে জমে থাকা গ্যাস হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে নারী-পুরুষসহ অন্তত পাঁচজন আহত হয়।

এমন ঘটনা নতুন নয়, বরং নিয়মিতই ঘটছে। এ কারণেই স্থানীয়রা বলছেন, এটি এখন একটি অভ্যাসগত বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিক ধারণা দিই, কিন্তু মূল তদন্তের দায়িত্ব অন্য সংস্থার। তাছাড়া এলাকার মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, পুরনো গ্যাস লাইন অবিলম্বে সংস্কার করতে হবে।রাসায়নিক গুদাম ও কারখানার জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।প্রত্যেক ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

একজন যুবক বলেন, আমাদের এলাকায় মানুষ আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছে। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই দাবি আমাদের বাঁচান।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি ঘটনায় আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকেও সতর্ক করা হয়েছে। তবে পুরো এলাকায় সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুর আলম বলেন, আমরা প্রতিটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। তবে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার সম্ভাবনাই বেশি।

সিদ্ধিরগঞ্জের বিস্ফোরণ এখন সাধারণ মানুষের কাছে এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন হাজারো পরিবার। প্রশাসন তদন্ত চালালেও মূল রহস্য থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। অন্যথায় একের পর এক বিস্ফোরণ মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নেবে, আর নারায়ণগঞ্জের অন্যতম ব্যস্ত এই শিল্পাঞ্চল পরিণত হবে ভয় ও আতঙ্কের নগরীতে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *